প্রায় সাত বছর পর গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’ ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, কারাগার থেকে বের হলেও ওই বাড়িতে আর উঠছেন না তিনি। শিগগিরই মালিককে বাড়িটি বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে খালেদা জিয়ার পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সূত্র বলছে, কারাগার থেকে বের হতে পারলে ফিরোজার একেবারে পাশেই খালেদা জিয়ার নিজের নামে বরাদ্দকৃত বাড়িটিতে উঠতে পারেন তিনি। ১৯৬ নম্বর গুলশান এভিনিউতে দেড় বিঘা জমির ওপর নির্মিত বাড়িটি বিচারপতি সাত্তার সরকারের সময়ে খালেদা জিয়ার নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তিন বেড, বিশাল ড্রয়িং, লিভিং রুম ও সুইমিং পুলসহ অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে ওই বাড়িতে। অন্যদিকে ডুপ্লেক্স হলেও ফিরোজায় লিফট নেই। ফলে পায়ের অসুখের কারণের নিজের ওই একতলা বাড়িতে ওঠার সম্ভাবনাই বেশি খালেদার। মাসিক কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে বর্তমানে ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকোর সিইওর (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) কাছে বাড়িটি ভাড়া দেওয়া আছে। বাড়িটির সামনে অনেক খালি জমিও পড়ে আছে। ঠিক এ বাড়ির পাশেই ‘ফিরোজা’য় ভাড়া থাকছিলেন খালেদা জিয়া।
গুলশান ২-এর ৭৯ নম্বর রোডের ‘ফিরোজা’ নামের বাড়িটির মালিক বিএনপি নেতা সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেজর (অব.) কামরুল ইসলামের ছেলে তানভীর ইসলাম। শহীদ মঈনুল হোসেন রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পর খালেদা জিয়াকে ওই বাড়িতে থাকার সুযোগ করে দেন তানভীর ইসলামের বাবা কামরুল ইসলাম। কিছুদিন ভাই শামীম এস্কান্দারের বাড়িতে থেকে ২০১২ সালের ২১ এপ্রিল ওই বাড়িতে ওঠেন খালেদা জিয়া। কিন্তু দুর্নীতি মামলায় কারাগারে যাওয়ায় গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে খালেদা ‘ফিরোজা’য় নেই।
বাড়িটিতে এখন সুনসান নীরবতা। সামনে দুই-তিনজন নিরাপত্তারক্ষী বাড়িটি পাহারা দিলেও তাঁদের মুখে হাসি নেই। কারণ বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল তাঁদের বেতন অনিয়মিত হয়ে গেছে। অনিয়মিত হয়ে গেছে বাড়িটিতে কর্মরত থাকা অন্য ছয়জন কর্মীর বেতনও। এ ছাড়া কয়েক মাস হয়েছে মালিককে বাড়িটির ভাড়াও দেওয়া হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে বাড়িটিকে ঘিরে গত কয়েক মাস ধরেই নানা আলোচনা তৈরি হয়। তবে বিষয়টি ‘স্পর্শকাতর’ হওয়ায় এ নিয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি বিএনপি নেতারা। অনেকেবার চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি তানভীর ইসলামের বাবা কামরুল ইসলামের সঙ্গেও। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
ঢাকা সিটি করপোরেশনে খোঁজ নিয়ে প্রাপ্ত চুক্তিপত্রে জানা যায়, খালেদা জিয়ার থাকার জন্য মাসিক তিন লাখ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে বাড়ির মালিকের সঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলী ফালুর বাড়ি ভাড়ার চুক্তি হয় খালেদা জিয়া ওই বাড়িতে ওঠার সময়ই। দুই বছর পর পর চুক্তিপত্র নবায়ন হলেও গত আগস্ট মাসে ওই চুক্তি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ফালু ওই চুক্তিপত্র আর নবায়ন করতে রাজি হননি বলে সিটি করপোরেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়।
বাড়িটির ভাড়াসহ ব্যয়ের কিছু অংশ আগে মেটাতেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা। কিন্তু শারীরিকভাবে অসুস্থ খোকা নিজেই এখন বিপদে আছেন। মামলা ও সরকারের হয়রানিসহ নানা কারণে খোকা ও ফালু দুই নেতাই কয়েক বছর ধরে বিদেশে আছেন। এমন পরিস্থিতিতে ওই বাসা ভাড়া বাকি পড়েছে। কিছুদিন আগে বিএনপির পক্ষ থেকে নতুন করে বাড়ি ভাড়া চুক্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন তা থেমে গেছে। এদিকে বেতন-ভাতা অনিয়মিত হওয়ায় খালেদা জিয়ার নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যাও কমে গেছে।
সোমবার সরেজমিনে দেখা গেছে, দুই-এক মাস আগেও খালেদা জিয়ার জন্য ১৫ জন নিরাপত্তারক্ষী (সিএসএফ নামে পরিচিত) থাকলেও এখন রয়েছে মাত্র আটজন। রাতেও তাঁরা ফিরোজায় থাকছেন। এ ছাড়া অন্যান্য কাজের জন্য আরো ছয়জন স্টাফ থাকেন ওই বাড়িতে। তাঁদের নিয়মিত বেতন দিতে প্রায় দেড় লাখ টাকার প্রয়োজন হয়। দীর্ঘদিন রক্ষণাবেক্ষণের কাজ না হওয়ায় দৃষ্টিনন্দন বাড়িটির সৌন্দর্যও হারিয়ে যাচ্ছে।
১৫ কাঠা জমির ওপর নির্মিত ‘ফিরোজা’ নামের ডুপ্লেক্স বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। ২০১২ সালে মাসিক সাড়ে আট লাখ টাকার বিনিময়ে বাড়িটি ভাড়া দেওয়ার চুক্তি হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল ক্লাবের সঙ্গে। কিন্তু খালেদা জিয়াকে থাকতে দেওয়ার জন্য ওই চুক্তি বাতিল করা হয়।
খালেদা জিয়া কারাগার থেকে কবে মুক্তি পাবেন তারও নিশ্চয়তা নেই। দুটি মামলায় তাঁর মোট ১৭ বছর সাজা হয়েছে। গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি একটি দুর্নীতি মামলায় সাজা হওয়ার পর থেকে কারাগারে রয়েছেন তিনি। আইনজীবীসহ বিএনপির সর্বস্তরের নেতারা মনে করেন, ‘রাজনৈতিকভাবে’ সমস্যার সমাধান না হলে শুধু আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলবে না। এ অবস্থায় ‘ফিরোজা’ ছেড়ে দেওয়ার কথা তিনি আত্মীয়দের কাছে বলেছেন বলে জানা গেছে।